মতামত



দেশদর্পণ ডেস্ক

এপ্রিল / ২৯ / ২০২৫


জলবায়ুঝুঁকি মূল্যায়ন: অতীত তথ্যের ওপর নির্ভর করা যাবে না


193

Shares


সাই চ্যান্দের র‍্যাভেলা


আমরা সবাই জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এ-সংক্রান্ত নানা ধরনের বিপদ রয়েছে দেশটির। যেমন বাংলাদেশ নিচু বদ্বীপ অঞ্চল, এর উপকূল ফানেল আকৃতির। এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমি বর্ষার হুমকিও আছে। এই বদ্বীপ এত ঝুঁকিতে, কিন্তু এখানে এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি অনেক। যুগপৎ এবং ধারাবাহিক ঝুঁকি বোঝার জন্য এখানে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজনীয়তা অনেক। এসব কারণেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

 এই অঞ্চলের বিপদের ধরন, পরিমাণ ও জটিলতা বিবেচনায় সবচেয়ে উন্নত মডেলিং, উন্নত মানের বিজ্ঞান এবং জরুরি সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের গবেষণার ফলাফল কেবল এ দেশের জন্য নয়; বরং ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং একই রকম অন্য উপকূলীয় ও বদ্বীপ অঞ্চলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হবে। এমআইটি ‘ক্লাইমেট গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ নামের একটি প্রকল্প চালু করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের কাজটি এই প্রকল্পের অধীনেই করা।

আমি মার্কিন নাগরিক, সেখানেই কাজ করি। তবে জন্মেছি ভারতে। আর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে আমার গভীর পারিবারিক সম্পর্ক আছে। তাই আমার কাজের ক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত জীবন—দুই অর্থেই এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। আমি বাংলাদেশিদের সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ পেয়েছি। তাদের উদারতা আমাকে আপ্লুত করেছে। আমি আশা করি, আমাদের এই কাজ সার্থক হবে এবং এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রশ্ন হলো, এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা কী বার্তা দিতে চাই।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো, আমরা ভবিষ্যতের ঝুঁকি বোঝার জন্য শুধু অতীতের তথ্যের ওপর নির্ভর করতে পারি না। জলবায়ু তো পাল্টাচ্ছে, আর ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনাগুলোও বারবার ঘটছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, আগে যেসব ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকে মনে করা হতো ১০০ বছরে একবার ঘটে, সেগুলো এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রতি ১০ বছর বা তারও কম সময়ে ঘটতে পারে। আমরা হাজার হাজার কৃত্রিম ঘূর্ণিঝড়ের সিমুলেশন চালিয়ে এমন পূর্বাভাস পেয়েছি। অর্থাৎ যেটা আগে ছিল বিরল, এখন সেটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।

দ্বিতীয়ত, আমরা এখন দেখছি অনেক ঝুঁকি একসঙ্গে আসছে। যেমন কোনো বছর ঘূর্ণিঝড় আর বর্ষার সময় একসঙ্গে হচ্ছে, আবার কোনো সময় তাপপ্রবাহ আর ঘূর্ণিঝড় একসঙ্গে আসছে। এ ধরনের একসঙ্গে আসা ঝুঁকিগুলো বেশির ভাগ পরিকল্পনায় বিবেচনা করা হয় না, অথচ বাস্তবে এর প্রভাব মোকাবিলা করতে গেলে এগুলো খুব জরুরি।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের কর্মসূচিগুলোকে এখনই ভালোভাবে ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে করা। স্রেফ অতীতের জলবায়ু তথ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের উপকূলে এখন বহু অবকাঠামোতে বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু অনেক অঞ্চল ও জনগোষ্ঠী এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে। যদি আমরা ভবিষ্যতের ঝুঁকির যথাযথ মূল্যায়ন না করি, তাহলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাবে। তাই আমি বলছি, দুর্যোগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তৎপরতা নয়, বরং সামনে আসা চরম বিপদের জন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এটা করতেই হবে যদি দেশটি আগামীর জটিল ও ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হতে চায়।

বাংলাদেশকে এখনই অতীতনির্ভর তথ্যের বাইরে এসে ঝুঁকিভিত্তিক ও ভবিষ্যৎমুখী জলবায়ু পরিকল্পনা নিতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার অনুমান, সীমিতসংখ্যক অতীত ঘূর্ণিঝড় এবং অপরিবর্তিত জোয়ারের তথ্যের ওপর নির্ভর করে আগে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই পদ্ধতি এখন আর যথেষ্ট নয়। এটি অত্যন্ত জরুরি বার্তা; অবিলম্বে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।

বর্তমানে অবকাঠামোগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে গতিশীল ও নানামুখী পরিকল্পনার ভিত্তিতে। এমনভাবে করতে হবে যেন ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য গতিপথগুলো সেখানে প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, এতে ঘূর্ণিঝড় ও বর্ষার একসঙ্গে হানা, জোয়ারের তীব্রতা বৃদ্ধি, পানি সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিভিন্ন ঝুঁকির ধারাবাহিক প্রভাব বিবেচনায় আনতে হবে। কমজোর পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে বড় পরিসরে বিনিয়োগ করা যাবে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিযোজন কৌশল অবশ্যই এমন হতে হবে যেন তা দিয়ে সব রকম বিপদ মোকাবিলা করা যায়। এগুলো বাস্তবসম্মত ও গতিশীল হতে হবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ এসব নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।


লেখক: সাই চ্যান্দের র‍্যাভেলা সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, এমআইটি


ওয়াইএফ/০১

মতামত