শিল্প ও সাহিত্য



দেশদর্পণ ডেস্ক

সেপ্টেম্বর / ১১ / ২০২৪


সাক্ষাৎকার : শিল্পকলা একাডেমি যেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে


23

Shares


দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেলেন নাট্যনির্দেশক ও শিক্ষক সৈয়দ জামিল আহমেদ। দায়িত্ব বুঝে নিয়ে গতকাল কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি। শিল্পকলা একাডেমিকে সাংস্কৃতিক কর্মীবান্ধব করা, শিল্পী ও সাধারণ মানুষের নাগালে আনা, দুর্নীতি দূর করে নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম চালু করাসহ পুরো শিল্পকলা একাডেমিকে ঢেলে সাজানোর মতো বড় দায়িত্ব এখন তাঁর কাঁধে। এসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন এম এস রানা।


মহাপরিচালক হিসেবে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা কেমন?

আমি বুঝতে শুরু করেছি, ভেতরের জটিলতাগুলো কোথায়। এদের অনেক ক্ষোভ আছে, সেই জায়গাগুলো পরিষ্কার হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, আস্থার একটা জায়গা তৈরি হচ্ছে বা হবে। আমিও পরিষ্কার বলেছি, আমরা ডিসিপ্লিন ওয়েতে কাজ করব। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ও ফিন্যান্সিয়াল—দুটো ক্ষেত্রেই ডিসিপ্লিনটা খুব জরুরি। আরও বুঝতে পারলাম, সেনাবাহিনীর একটা বড় দল ওখানে থাকে। রাষ্ট্রও চাইছে নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারা যেন আপাতত এখানে থাকে। কাজেই তারা যত দিন আছে, হলগুলো খোলা সম্ভব হচ্ছে না। আরও বেশ কিছু সমস্যা আছে, সমস্যাগুলো জটিল; এটা বুঝতে পেরেছি আজ।


তার মানে, দ্রুতই হলগুলো খুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না? 

এটা এখনই বলতে পারছি না কারও সঙ্গে কথা না বলে। আজ শিল্পকলার কর্মচারীদের সঙ্গেই মূলত কথা বলেছি। আরও পক্ষ আছে, সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেনাবাহিনী ওখানে আছে, এ বিষয়েও সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এখানে সবকিছু যেন সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে, সেটাও দেখতে হবে। কাজেই দু-একটা দিন যাক, তারপর সব পরিষ্কারভাবে বলতে পারব। 


দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকলার নানা বিষয় নিয়ে নাট্যকর্মী ও শিল্পীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। আপনার কী মনে হয়, কোন কোন বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজন আছে?

দুটো জায়গায়। একটা হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যাপারে স্বচ্ছতা, আরেকটা হলো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জায়গায় স্বচ্ছতা। আজ যেটা বুঝলাম, অনেকের নিয়োগ আটকে আছে, অনেকের পদায়ন-পদোন্নতি আটকে আছে। এসবের একটা সুষ্ঠু সমাধানের প্রয়োজন আছে। 


শিল্পকলা একাডেমিকে নতুন করে কীভাবে ঢেলে সাজাবেন ভাবছেন?

ফিন্যান্সিয়াল এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্বচ্ছতা যদি আসে, তাহলে ভেতরের ক্ষোভ দূর হবে বলে মনে করি। তা হলে কর্মীরা স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারবেন। আর হলগুলো খুলে দিয়ে, যে কারণে শিল্পকলা একাডেমি তৈরি করা হয়েছে, সেসব কাজ যেন করা যায়, সেই চেষ্টাটা থাকবে। 

ঢেলে সাজাতে কিছু সময় লাগবে। তবু সবদিক বিবেচনা করে এক মাসের মধ্যেই পরিষদের একটি সভা করে আমরা পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করব।


কোন বিষয়গুলো শুরুতে প্রাধান্য পাবে?

ফিন্যান্সিয়াল এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্বচ্ছতা। এ বিষয়ে আজকে আলোচনাও করেছি। আর যেটা চাইব, আমাদের এখানে একটা কাউন্সিল থাকার কথা, এই পরিষদ কিন্তু সবকিছু নির্ধারণ করে। এই পরিষদের এখন কার্যকরী কোনো ভূমিকা নেই। পরিষদ দ্রুত চালু করতে হবে। আমি যেটা করব, ডিরেক্টর জেনারেলের যেন ওই পরিষদের কাছে জবাবদিহি থাকে, সেটা নিশ্চিত করব। এই পরিষদ তিন মাসে অন্তত একবার বসবে। আরেকটা বিষয় আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ একটি এক্সিকিউটিভ কমিটি হওয়ার কথা। পরিষদ থেকে সাতজন সদস্য নিয়ে এই কমিটি হওয়ার কথা এবং এই কমিটি প্রতি মাসে একটা সভা করে করণীয় নির্ধারণ করবে। এখন কিছু জটিলতা আছে; কারণ, এই পরিষদে আবার তিনজন এমপি থাকার কথা রয়েছে। এখন তো কোনো এমপি নেই। এই জায়গাগুলো তাই ঢেলে সাজাতে কিছু সময় লাগবে। তবু সবদিক বিবেচনা করে এক মাসের মধ্যেই পরিষদের একটি সভা করে আমরা পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করব। 


এক যুগের বেশি সময় এই প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সাবেক মহাপরিচালককে দুদকের মুখোমুখিও হতে হয়েছে। সেই সব ঘটনা নতুন কাজে কতটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? বাধা হলে কীভাবে সেটা মোকাবিলা করবেন?

এটা নিয়ে তো একটা নিয়মতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। দেখেন নিয়ম আছে, আবার আইনও আছে। কিন্তু নিয়মের বাইরে যখন যাচ্ছেন, তখনই সেটা অনিয়ম, সেটা এক টাকার জন্য হোক কিংবা কোটি টাকার জন্য। আগে যা হয়েছে, তার একটি অডিট করা হবে। এরপর আমি যেটা করব, যেখানে যা নিয়ম আছে, সেই নিয়মের ভেতরেই সব কাজ করার চেষ্টা করব। এবং কাজে কোনো ধরনের ফাঁকি যেন না হয়, আমিসহ সবাই সেই চেষ্টাটা করব।


শিল্পকলার দুর্নীতি দমনে এবং ভবিষ্যতে যেন প্রতিটি কাজ নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়, সেই লক্ষ্যে আপনার করণীয় বা পরিকল্পনা কী? 

এটি তো ফিলোসফিক্যাল একটা প্রশ্ন। দেখুন, সবকিছুতেই একটা সিস্টেম বা স্ট্রাকচার থাকে। আমার মনে হয়, স্ট্রাকচারের সঙ্গে এজেন্সিও গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে, অনিয়ম ব্যক্তিও করতে পারে। কাজেই, আমার পরে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছাপূরণে সেই স্ট্রাকচার ভাঙতে চায়, তাহলে তারা পথ খুঁজে বের করবেই। আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন, এখন সেই বুদ্ধিটা সে কোথায় প্রয়োগ করবে, সেটা নির্ভর করে তার ওপর। তাই আমার মনে হয় না, এ বিষয়ে কেউ কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে। তবে আমার চেষ্টা থাকবে। আপনাদের তরফ থেকেও কোনো পরামর্শ থাকলে দিতে পারেন। সবাই মিলে চেষ্টা করতে পারি। 


শিল্পকলা একাডেমিকে সাধারণ শিল্পী ও মানুষের নাগালে আনতে কী পদক্ষেপ নেবেন?

এটা বিশাল বড় প্রশ্ন। শুধু নাটকের ক্ষেত্রেই যদি দেখেন, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এল, ওইখান থেকেই মনে হয়, আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা রাষ্ট্রের পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করি। ধীরে ধীরে গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে দু-একজন ছাড়া আমাদের অবস্থান ছিল কোনো রকম ক্রিটিক উপস্থাপন না করা। আমি যখন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ করেছিলাম, তখন আমার ওপর চড়াও হয়েছিল অনেকে। আমি নাকি ইতিহাস বিকৃত করছি। সবাই যখন নিজ নিজ ভূমিকা পরিষ্কার করবেন, বিশেষ করে শিল্পীরা—যে তাঁদের ভূমিকাটা কী, সিভিল সোসাইটির ভূমিকা রাষ্ট্রকে কতটা ক্রিটিক করবে, যেটা সত্তর-আশির দশকে ছিল, তারা বলেছে রাষ্ট্র কী করছে, কী বলছে, এগুলো ভুল, এগুলো ঠিক। এ রকম নানাবিধ ক্রিটিক কিন্তু তখন ছিল। মামুনুর রশীদ এক রকম চিন্তা করছেন, তিনি মার্ক্সবাদ নিয়ে বলছেন, আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে মধ্যবিত্ত জীবনের কথা আছে, ওদিকে নাটকের দল নাগরিক ইউরোপীয় নাটক নিয়ে করেছে রাষ্ট্রকে ক্রিটিসিজম। গত ১৫ বছরে এসব কিন্তু হারিয়ে গেছে। আমাদের এখানে শিল্পকলার কাজ করার জায়গাটা খুব কম, এখানে জায়গাটা বেশি সাংস্কৃতিক কর্মীর। আমরা বা শিল্পকলা যেটা করতে পারি, সেটা হচ্ছে সাপোর্ট এবং এই সাপোর্টটা হবে একেবারে জেলা বা গ্রাম পর্যায়ে। আমরা যদি উৎসব করতে পারি, যাঁরা গান করেন তাঁদের নিয়ে নানা আয়োজন করতে পারি। কবিগানের মতো অসাধারণ একটা বিষয় যদি ফিরিয়ে আনতে পারি; যেখানে ডিবেট হয়, নারী-পুরুষ, মুসলিম-হিন্দু—এ রকম নানা বিষয় নিয়ে। ধর্ম, রাষ্ট্র, জীবন—সব ধরনের কথা হোক পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে। এভাবে যদি শিকড় পর্যায়ে কাজ করা যায়, তখন আমার মনে হয় একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ আসবে। আবারও বলছি, সব ধরনের মানুষ, সব ধরনের শিল্পী আসুক এসব জায়গায়। একটা কথা না বললেই নয়, সবাই চায়, আমাকে এটা দিতে হবে, ওটা দিতে হবে। আমার কথা হচ্ছে, চাচ্ছেন তো; কিন্তু আপনি কী দেবেন, কিছু তো দিতে হবে, আপনাকে কিন্তু কোয়ালিটি এনশিওর করতে হবে, ভালো নাটক দিতে হবে। 


শিল্পচর্চাকে সারা দেশে আরও ছড়িয়ে দিতে কী করা যেতে পারে?

শিল্পকলার সাপোর্টটা জোরালো করা হবে। তবে কোয়ালিটি কনফার্ম করতে হবে। আমি বলব, যাঁরা গান করছেন, তাঁরা গ্রামে চলে যান। দেখুন, মানুষ আপনার গানের গ্রামটাকে বোঝে কি না, ওই জনপ্রিয়তাটা নিয়ে আসেন, হাততালিটা নিয়ে আসেন ওইখান থেকে। আবার গ্রামটাকেও নিয়ে আসতে পারেন শহরে। আমাদের পাহাড় আছে, নানা কমিউনিটি আছে, তাদের কাজ ঢাকায় নিয়ে আসুন, ঢাকার কাজ পাহাড়ে যাক। আমরা যেন বুঝি, পাহাড়ে সমস্যাটা কী। এই রকম নানা আদান-প্রদান ঘটুক আমাদের চিন্তায়।


শিল্পকলার নানা সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে আছে বলে দাবি করছেন শিল্পীরা। কোনো কিছু নষ্ট হলে সেটা নানা নিয়মের ফাঁদে পড়ে চট করে সারানোও যায় না বলে অভিযোগ আছে। এতে নাট্যকর্মীদের কাজে অসুবিধা হয়। নিয়মের এই দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? 

চেষ্টা করব, যত দ্রুত সম্ভব এগুলো ঠিক করার। আমিও দেখেছি, যেমন লাইটগুলো নষ্ট পড়ে আছে। কেন? এগুলো কেন আসবে না? কার সুবিধা এতে? এগুলো অবশ্যই ঠিক করা হবে। তবে এগুলো যাঁরা ব্যবহার করছেন, তাঁদেরও একটা দায়বদ্ধতা আছে, এগুলো সঠিকভাবে যত্ন করে ব্যবহার করতে হবে। এগুলো বড় সমস্যা নয়, এটা সহজে সমাধান করা যাবে বলে আমার বিশ্বাস। 


সাদাচোখে শিল্পকলায় আমরা নাট্য প্রদর্শনীটাই নিয়মিত দেখি। বাকি বিভাগগুলো অবহেলিত রয়ে গেছে। যদিও শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, প্রযোজনাসহ নানা বিষয়ে ছয়টি বিভাগ রয়েছে। অন্য বিভাগগুলোকে সক্রিয় করতে কী করা যেতে পারে? 

হ্যাঁ, এটা আমিও দেখেছি। এই বিভাগগুলোর সব কটি যেন চালু থাকে এবং উজ্জীবিত রাখা যায়, সে ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে আবার তাঁদের (শিল্পকলার কর্মী) কথা হচ্ছে, গত বছরগুলোতে শিল্পকলা বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানই করে গেছে, শিল্পকলা একাডেমি যেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। ধীরেসুস্থে এগুলো অবশ্যই ঠিক করতে হবে। 


মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্র, সংগীত বা ব্যান্ডের শিল্পীদের সঙ্গে শিল্পকলার নিয়মিত সম্পৃক্ততা চোখে পড়ে না। অন্যান্য বিভাগের কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা নেই বললেই চলে। এসব কীভাবে দূর করা সম্ভব?

দূর করা তো অবশ্যই সম্ভব। সময় দিন। ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই এসব নিয়ে আমরা কাজ করব।


ওয়াইএফ/০৩

শিল্প ও সাহিত্য